অনলাইন ডেস্ক: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘কেউ কথা রাখেনি।’ অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক প্যাট কামিন্স অবশ্য হেঁটেছেন বিপরীত পথে। ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে আগেই বলেছিলেন, আহমেদাবাদে দর্শকদের স্তব্ধ করে দিতে চান তিনি। শেষ পর্যন্ত কথা রেখেছেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা। আহমেদাবাদ তো বটেই, পুরো ভারতকেই স্তব্ধ করে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ভারতের মাটিতে ২০২৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের শিরোপা জিতল অজিরা। ওয়ানডে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৬ষ্ঠ বিশ্বকাপ শিরোপার রেকর্ডও গড়ল তারা।
আজ (রোববার) আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম পরিণত হয়েছিল নীলের মহাসমুদ্রে। নিজ দেশে এক যুগ পর বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরবেন রোহিত শর্মারা, এমন স্বপ্নেই বিভোর ছিলেন কোটি ভারতীয় সমর্থক। সেই কক্ষপথেই ছিল দলটি। কিন্তু পথের কাটা হয়ে দাঁড়ালেন ট্রাভিস হেড এবং মার্নাস ল্যাবুশেন। দুজনেই ধীরে ধীরে ভারতের কাছ থেকে ম্যাচটাকে নিয়ে গেলেন অনেকটা দূরে। শেষ পর্যন্ত তারাই গড়ে দিলেন ব্যবধান। ভারতের দেওয়া ২৪১ রানের টার্গেট তাড়ায় অস্ট্রেলিয়া জিতল ৬ উইকেটের বড় ব্যবধানে।
দিনের শুরুতে টস হেরে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ পেয়েছিল ভারত। অবশ্য টিম ইন্ডিয়া কাপ্তান জানিয়েছিলেন, তিনি টস জিতলে ব্যাটিংই নিতেন। কিন্তু ব্যাটে সেই আত্মবিশ্বাস দেখা যায়নি। অস্ট্রেলিয়ার পেসারদের আগুনে বোলিংয়ের সামনে প্রত্যাশিত ব্যাটিং হয়নি ভারতের। পুরো বিশ্বকাপে এদিনই প্রথম চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল ভারতের মিডলঅর্ডার। সেবারই চ্যালেঞ্জ নিতে ব্যর্থ হলেন টিম ইন্ডিয়ার ব্যাটাররা। পুরো ম্যাচে টানা বাউন্ডারি খরায় ভুগেছেন ভারতীয় ব্যাটাররা। দুই দফা মিলিয়ে টানা ৩৫ ওভার বাউন্ডারির দেখা পাননি ভারতের মিডল অর্ডার। স্বাভাবিকভাবেই রানটা মনমতো হয়নি তাদের।
কিন্তু ২৪১ রানের লক্ষ্যে বোলিং যেমন হওয়া দরকার ছিল, ঠিক তেমনই বল করেছে ভারতের বোলাররা। জাসপ্রিত বুমরাহ আর মোহাম্মদ শামিকে শুরুতে সামাল দিতেই পারেনি অজি ব্যাটিং লাইন-আপ। ডেভিড ওয়ার্নার, মিচেল মার্শ আর স্টিভেন স্মিথ তিনজনেই পরাস্ত হয়েছেন দূর্বল ফুটওয়ার্ক আর নিজেদের ভুলে। কিন্তু ম্যাচে ভারতের সুখ টিকেছে ওই পর্যন্তই। ট্রাভিস হেড এরপর ভারতের মাথার ব্যাথা বাড়িয়েছেন আর মার্নাস ল্যাবুশেন ছিলেন চীনের প্রাচীর হয়ে। চতুর্থ উইকেট জুটিতে যেন ম্যাচটাকেই ছিনিয়ে নিলেন তারা।
অথচ শুরতেই ওয়ার্নারকে ফিরিয়ে দারুণ সূচনা এনে দিয়েছিলেন শামি। দ্বিতীয় ওভারেই বিরাট কোহলিকে স্লিপে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেছেন ফর্মের তুঙ্গে থাকা এই পেসার। দলীয় ১৬ রানেই প্রথম উইকেটের পতন। ভরসা ছিল মিচেল মার্শের উপর। দূর্বল ফুটওয়ার্কের মাশুল দিয়েছেন তিনিও। বুমরাহর বলে উইকেটের পেছনে কেএল রাহুলের হাতে আটকা পড়েছিলেন এই অলরাউন্ডার।
স্টিভেন স্মিথ আউট হয়েছেন নিজের আর আম্পায়ারের মিলিত ভুলে। বলের ইম্প্যাক্ট ছিল স্ট্যাম্পের বাইরে। কিন্তু আম্পায়ার আঙুল তুলেছেন। খানিক দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগা স্মিথও আর রিভিউ নেননি। হাঁটা দিয়েছেন প্যাভিলিয়নের দিকে। এটাই যেন পুরো ম্যাচে ভারতের শেষ উৎসব। এরপর ক্রিজে থাকা হেড আর ল্যাবুশেন কেবল যন্ত্রণাই বাড়িয়েছেন ম্যান ইন গ্রিনদের। তাদের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে গ্যালারীতে নেমেছে শ্মশানের নীরবতা।
পুরো ম্যাচে আর একবারই সুযোগ পেয়েছিল ভারত। বুমরাহর বলে এলবিডব্লিউর আবেদন ফিরিয়ে দেন আম্পায়ার। পরে রিভিউতে দেখা গেল আম্পায়ার্স কল। হতাশায় মুখ ঢাকতে বাধ্য হলেন পুরো দল।
লম্বা এই জুটির পথে সেঞ্চুরি পেয়েছেন ট্রাভিস হেড। ৯৫ বলে স্পর্শ করেছেন তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার। আর ৯৯ বলে ধৈর্য্যশীল এক ইনিংস খেলে অর্ধশতকের দেখা পেয়েছেন ল্যাবুশেন। ম্যাচটা অবশ্য শেষ করা হয়নি ট্রাভিস হেডের। দলের জয় থেকে মাত্র ২ রান দূরে থাকতে মোহাম্মদ সিরাজের বলে আউট হয়েছেন তিনি। তবে এর আগেই খেলে ফেলেছেন ১৩৭ রানের ম্যাচজয়ী এক ইনিংস। আর তাতেই ২০১৯ সালে হারিয়ে ফেলা বিশ্বকাপটা আজ আবারও ফিরছে অস্ট্রেলিয়াতে।
এর আগে দিনের শুরুতে টস জিতে প্রতিপক্ষকে ব্যাটিংয়ে পাঠান অজি অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। দিনের প্রথম ইনিংসে বড় শিরোনাম হয়ে থাকবে ভারতীয় ব্যাটারদের বাউন্ডারি না পাওয়া। পাওয়ারপ্লেতে ৮০ রান তোলার পরে হঠাৎ করেই যেন মিলিয়ে যায় ভারতীয় ব্যাটারদের। রোহিত শর্মা-শুভমান গিলরা ব্যর্থ হয়েছেন বড় স্কোর করতে।
এরপর বিরাট কোহলি আর লোকেশ রাহুল দলের হাল ধরলেও রান তোলার গতি কমে এসেছে অনেকখানি। ৮ এর কাছাকাছি থাকা রানরেট নেমে যায় ৩ এর ঘরে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় টানা ১৫ ওভারের বাউন্ডারিখরা। মাঝে রাহুলের ব্যাট থেকে একটা চার এলেও তাতে আর লাভ হয়নি। ইনিংসের শেষ ২০ ওভারে ভারত বাউন্ডারি হাঁকিয়েছে মাত্র ১টি। সেটাও এসেছে সিরাজের ব্যাট থেকে।
ভারতের ইনিংসে বড় স্কোর ছিল কেবল রাহুল আর কোহলির। দুজনেই পেয়েছেন পঞ্চাশের দেখা। কিন্তু রাহুল ফিরে যাওয়ার পর আর কেউ বড় স্কোর করতে না পারায় তাদের ইনিংস থেমে যায় ২৪০ রানেই। অস্ট্রেলিয়াকে ফাইনালে আটকানোর জন্য যা মোটেই যথেষ্ট ছিল না।