গেরস্তের নুন-পান্তা

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি আর নতুন কথা নয়। প্রায় সারা বছর মূল্যবৃদ্ধির আঁচে সাধারণ মানুষের হাত পুড়ে। গরিব মানুষদের কথা বাদই দিলাম, মধ্যবিত্ত পরিবারেও আজ নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা। বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব এসে পড়ছে বাজারে।

অস্বাভাবিক বেড়েছে ভোজ্যতেল ও চালের দাম। বেড়েই আছে সবজি ও ডিমের দাম। মাংসে হাত দেওয়ার সাহস খুব বেশি মানুষের নেই। ভোজ্যতেলের মূল্য প্রতিদিন চড়চড় করে বেড়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। সাধারণ বাড়িতে তেল দিয়ে খাওয়া যেন আজ বিলাসিতা।

 এই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের একটি অগ্রাধিকার কার্যক্রম হওয়া উচিত। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে বাজারে সরকারকে আর্থিক সংস্থান বাড়ানোর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নজরদারি শক্তিশালী করা।

বছরের শুরু থেকেই নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন। এতে অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে মূল্যস্ফীতির হার। বিশেষ করে সয়াবিন তেল ও ডিমের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। ফলে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ, যা গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে যে, গত জানুয়ারি মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

চিত্রটা খুব স্বচ্ছ- মূল্যস্ফীতির চাপ সামলানো যাচ্ছে না, তাই নিত্যপণ্যের দামেও লাগাম টানা যাচ্ছে না। একটি পত্রিকা- ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারিতে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা ও গত বৃহস্পতিবারের তালিকা ধরে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, মোটা চালের দাম ১৫, মোটা দানার মসুর ডাল ৭৭, খোলা সয়াবিন তেল ৫৪, চিনি ৪৯ ও আটার দাম ২১ শতাংশ বেড়েছে। ভোজ্যতেলের বাজার একদম নিয়ন্ত্রণহীন।

মধ্যম আয়ের পাঁচজনের একটি পরিবারে গড়পড়তা ৫ লিটার সয়াবিন তেল লাগে। টিসিবির হিসাবে, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি পাঁচ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৪৬৫ থেকে ৫১০ টাকা, এখন তা ৭৪০ থেকে ৭৮০ টাকা। মানে হলো, শুধু সয়াবিন তেল কিনতে একটি পরিবারের ব্যয় বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। ফার্মে উৎপাদিত মুরগির দাম বছরজুড়েই বেশি থাকছে। শুধু মুদিদোকান ও কাঁচাবাজারের খাদ্যপণ্য নয়, বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও।

কোভিড পরিস্থিতিতে বহু মানুষেরই হয় চাকরি নেই অথবা কর্মক্ষেত্রে কাজের সংকোচন ঘটেছে। ফলে উপার্জন প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বহু পরিবারকে জটিল অবস্থায় নিক্ষেপ করেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে সরকারি হিসাবে। কিন্তু নিজের আশেপাশে দেখতে পাই অনেকেরই আগের চেয়ে আয় কমে গেছে। ক্ষুদ্র ও খুচরা ব্যবসায়ীরা এখনও তাদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

অবস্থার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির কথায়। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিককে তিনি বলেছেন, ‘টিসিবির লাইন বড় হচ্ছে, ভালো ভালো পোশাক পরা মানুষদেরও এখন টিসিবির লাইনে দেখা যাচ্ছে’। সমস্যাটা যে বাজার ব্যবস্থাপনা ও বাজার তদারকির তারও সায় মিলল মন্ত্রীর কথায়। বললেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এবার জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতা নেওয়া হবে।

পুরো বিষয়টি শাসন ব্যবস্থার সাথেও সম্পর্কিত। ক্রমান্বয়ে রান্নার গ্যাস, পেট্রল-ডিজেল-অকটেনেরে দাম, কেরোসিনের দাম, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানো প্রকৃতপক্ষে জনবিরোধী নীতি। সরকার প্রায়ই বলে থাকে যে, জ্বালানি তেলের দাম নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ওপর। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে এ দেশে দাম বাড়ে। কিন্তু দাম কমলে আমাদের দেশে দাম কমে না।

করোনাকালে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম একেবারে তলানিতে ঠেকেছিল। কিন্তু সরকার দাম কমাল না। ভারতে জ্বালানির দাম বেশি বলে পাচার হয়ে যাবে, এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। পণ্য পাচার ঠেকানোর দায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। তাদের ব্যর্থতার দায় জনগণের ওপর চাপানো গণবিরোধী মানসিকতা।

ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় বেড়েই চলছে মধ্যবিত্তের বোঝা। একটা কথা প্রায়ই বলা হয় যে, বাজারে চলছে সিন্ডিকেটের কারসাজি। বড় বড় কিছু ভোগ্যপণ্য কোম্পানি একত্রিত হয়ে জিম্মি করছে সরকার ও জনগণকে। প্রশ্ন হলো, সিন্ডিকেটের হাত কী সরকারের চেয়েও লম্বা? এ অবস্থা সৃষ্টির মূল কারণ হলো বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা ও বাজারে মনিটরিংয়ের অভাব। বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ী, খাদ্রমন্ত্রীও ব্যবসায়ী। অথচ এই দুজনই সামলে উঠতে পারছেন না যার যার ক্ষেত্র।

২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পে-স্কেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রত্যেক স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন দ্বিগুণ বাড়িয়েছিল। সরকার মূলত এটি করেছিল দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। প্রধানমন্ত্রী সে সময় বলেছিলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনেকেই দুর্নীতি করে অর্থাভাবে। ফলে তাদের যদি পর্যাপ্ত বেতন দেওয়া যায় তাহলে তারা হয়তো দুর্নীতির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী এখনও একইভাবে দুর্নীতি করছে। বাজার ব্যবস্থা মনিটরিংয়ের সঙ্গে যুক্ত এ অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারণে আজ দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি, যা জনগণের সহ্যের সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে।

এই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের একটি অগ্রাধিকার কার্যক্রম হওয়া উচিত। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে বাজারে সরকারকে আর্থিক সংস্থান বাড়ানোর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নজরদারি শক্তিশালী করা।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ।

Comments (০)
Add Comment