বরিশাল শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের হিসাব রক্ষন কর্মকর্তার সম্পদের পাহাড়

  • স্টাফ রিপোর্টার॥ বরিশাল শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা মোঃ সহিদুর রহমান। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।

নানা উপায়ে অতিরিক্ত ব্যয় প্রাক্কলন, দরপত্র প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়ম, প্রকৌশলীদের অনৈতিক সুবিধা আদায়সহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে করে তিনি এই সম্পদের অধিকারী হয়েছেন।

প্রাথমিক তথ্য অনুসন্ধানে তার সম্পদের পরিমাণ ১৫ কোটি টাকারও বেশি! অথচ তিনি চাকুরীতে বহাল বাবদ এ পর্যন্ত সরকারি কোষাগার থেকে সর্বসাকল্য যে বেতন পেয়েছেন তার বিপরীতে স্বাভাবিকভাবেই তার এই বিপুল সম্পত্তি নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সাধারণ জনমনে। অবৈধ পন্থায় দূর্নীতি করে তিনি বরিশাল নগরীর সার্কুলার রোডে গড়ে তুলেছেন ৫ তলা আলীশান বাড়ী। বিএম স্কুল রোডে ট্রাফিক অফিসের বিপরীতেও রয়েছে আরেক আলীশান বাড়ী। গ্রামের বাড়ী গৌরনদীতে গড়েছেন ব্যাপক সম্পদ।স্ত্রী, নিকটাত্নীয়সহ নামে বেনামে গড়েছেন এসব সম্পদ।

অনিয়মই এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে বরিশাল শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে। দুর্নীতি-অনিয়ম কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না এখানে। নানা উপায়ে অতিরিক্ত ব্যয় প্রাক্কলন, দরপত্র প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়ম, প্রকৌশলীদের অনৈতিক সুবিধা আদায়সহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির উৎসব চলছে এই দপ্তরে।

জানা যায়, কয়েকজন ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এই দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম কাজ পাইয়ে দেওয়া, নিজে নেওয়া, বিল ও জামানতের চেক পরিশোধের ক্ষেত্রে গুনে গুনে বুঝে নেন কমিশন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঠিকাদার জানান, বরিশালের বাবুগঞ্জ, আগৈলঝাড়া, মেহেন্দিগঞ্জ ও মুলাদীতে কারিগরি স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) স্থাপনের কাজের বাবুগঞ্জ ও আগৈলঝাড়ার কারিগরি স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) স্থাপনের দুইটি কাজ তিনি বসুন্ধরা হাউজিং (প্রাঃ) লিঃ নামক ঠিকাদারী লাইসেন্সের মাধ্যমে নিজে ভাগিয়ে নেন। পরবর্তীতে ৩২ কোটি টাকার কাজ দুইটি ৭% কমিশনে বিক্রী করে দেন। অবশ্য তিনি বরিশালে যোগদানের পর থেকেই অতিরিক্ত ব্যয় প্রাক্কলন এবং বাছাই করা উন্নয়ন কাজগুলো নিজেই বিভিন্ন কৌশলে ভাগিয়ে নিয়ে বিক্রিী করে দিয়ে আসছেন।

গত বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ১১ টায় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের প্রকৌশলী মফিকুল ইসলাম বরিশাল এসেছিলেন বাবুগঞ্জ, আগৈলঝাড়া, মেহেন্দিগঞ্জ ও মুলাদীতে কারিগরি স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) স্থাপনের কাজের কমিশন নিতে। বরিশাল শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম বরিশাল সার্কিট হাউজে তার সাথে অবস্থান করতেছিলেন। এমন সময় কমিশনের অগ্রিম পয়ত্রিশ লক্ষ টাকা তার দপ্তরের কম্পিউটার অপারেটর রাশেদের নিকট জমা দেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের প্রতিনিধি। নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল কমিশনের টাকা নিয়ে কম্পিউটার অপারেটর রাশেদকে বরিশাল সার্কিট হাউজে আসতে বলেন। কিন্তু কম্পিউটার অপারেটর রাশেদ সমুদয় টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান, বন্ধ করে ফেলেন ব্যবহৃত মোবাইল। তার এমন কান্ডে নাজেহাল হয়ে পড়েন নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল।

শুরু হয় তুলকালাম কান্ড, পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কম্পিউটার অপারেটর রাশেদের গ্রামের বাড়ী থেকে নির্বাহী প্রকৌশলীর সরকারী গাড়ীতে বরিশাল শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে আনা হয় স্ত্রী, সন্তান ও ভাইকে। গভীর রাত পর্যন্ত তাদের দেয়া হুমকি-ধামকি। কিন্তু কম্পিউটার অপারেটর রাশেদের স্ত্রী পাল্টা হুমকি ছেড়ে নির্বাহী প্রকৌশলীকে বলেন- আমার স্বামীকে খুজে পাচ্ছি না, তার কিছু হলে আমি আপনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব। এতে ঢের নাজেহাল হয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল- ছেড়ে দে মা কেদে বাচি অবস্থায় কম্পিউটার অপারেটর রাশেদের স্ত্রী, সন্তান ও ভাইকে ফের নির্বাহী প্রকৌশলীর সরকারী গাড়ীতে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার গ্রামের বাড়িতে পৌছে দেন।

সকলের নিকট সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে বরিশাল শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলামের কমিশন দূর্নীতি। বরিশালে যোগদানের পর থেকেই সে এভাবেই দূর্নীতির দূর্গ গড়েছেন। তার দূর্নীতির দূর্গ সচল রাখতে তিনি ঢাকাস্থ সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আলতাফ হোসেনকে প্রতি সপ্তাহে ইলিশের ঝুড়ি পাঠাতেন। এরফলে তিনি কোন নিয়মের তোয়াক্কা করেন না।

জানা যায়, বরিশাল শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রাক্কলন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি, সমঝোতার নামে নির্বাহী প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলীরা অনৈতিক সুবিধা আদায় করছেন। শিক্ষা প্রকৌশল সংশ্লিষ্টরা জানান, অসাধু প্রকৌশলী-ঠিকাদার সিণ্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ায় বরিশাল শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হচ্ছে। ঠিকাদারদের থেকে প্রতি প্রকল্পের নির্ধারিত অনৈতিক ঘুষ ও পার্সেন্টিস নিয়ে বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী হয়েছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ।

তিনি বর্তমানে নিজেকে জামায়াত সমর্থিত কর্মকর্তা দাবী করলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেমোরিয়াল কতৃক অনুমোদিত বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের গত ২৭/০৭/২০২২ ইং ঘোষিত আহবায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। এসব বিষয়ে দুদক ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহ অনুসন্ধান করলে থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই দপ্তরের দুইজন কর্মকর্তা জানান, বরিশাল শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে ৭-৮ জনের একটি ঠিকাদার সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। তারা বর্তমানে নির্বাহী প্রকৌশলী স্যারের ছত্রছায়ায় থেকে বড় বড় প্রকল্প হাতিয়ে নিয়েছেন। তাদের এসব কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মোটা অঙ্কের কমিশন দিচ্ছেন।

ঠিকাদারদের অভিযোগ, বরিশাল জেলার শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তের নির্বাহীকে ম্যানেজ করে অসাধু ঠিকাদার সিণ্ডিকেট অনেক প্রকল্পের কাজ হাতিয়ে নিয়েছে। এই প্রকৌশলী এতটাই বেপরোয়া ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নিয়ে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে তাদেরকে প্রকল্পের কাজগুলো দিয়েছেন। তবে এই ঠিকাদাররা কাজ করে না, চড়া দামে সাধারণ ঠিকাদারদের কাছে প্রকল্প বিক্রি করে দেয়। এতে করে তারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

তথ্য সূত্রে জানা যায়, নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম ও তার সকল দুর্নীতি-অনিয়মের একান্ত সহযোগী উপ-সহকারী প্রকৌশলী আশিকুর রহমান, শহিদ-আশিক মিলে শিক্ষা প্রকৌশলে কায়েম করেছে অনিয়মের রাম-রাজত্ব। তাদের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্যের কারণে সাধারণ ঠিকাদাররা অতিষ্ঠ। তবে প্রভাবশালী ৬-৮ জনের ঠিকাদাররাই এখানে সর্বেসর্বা। সাধারণ ঠিকাদারদের নানাভাবে হেনস্থা করেন তারা।

এসকল অনিয়ম-দুর্নীতির উৎসবের প্রধান সেনাপতি হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা মোঃ সহিদুর রহমান। অনেক ঠিকাদারের মতে- ডাবল শহীদ আর আশিক বরিশাল শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মালিক। গণমাধ্যম থেকে তাকে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেন নাই। নির্বাহী প্রকৌশলীকে ফোন করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেন নাই।

তবে নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলামের সকল দুর্নীতি-অনিয়মের একান্ত সহযোগী উপ-সহকারী প্রকৌশলী আশিকুর রহমান এসকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী তারেক আনোয়ার জাহেদী বলেন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে যে কারো কোন দুর্নীতি-অনিয়ম কোনোভাবেই মেনে নেব না, তদন্ত করে দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Comments (০)
Add Comment