Take a fresh look at your lifestyle.

অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিপর্যস্ত বরিশাল বিএনপি, দলীয় রোড মার্চ কর্মসূচিতে সংঘর্ষের শঙ্কা

বিশেষ প্রতিবেদকঃ
বরিশাল বিএনপির নেতাদের দলের আন্দোলন নিয়ে তাদের তেমন কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ব্যস্ত কমিটি বাণিজ্য আর অর্থের ধান্ধায়। বরিশালের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় দুই নেতার এই বিরোধ এখন বরিশাল মহানগর ও জেলা বিএনপি থেকে শুরু করে বরিশালের ১০টি উপজেলা, সাতটি পৌরসভাসহ ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

 

বিরোধ এতোটাই প্রকট যে, অসংখ্য গ্রুপে বিভিক্ত বিএনপি দলীয় কর্মসূচিও পালন করে আলাদা আলাদা। আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশালে রোড মার্চ কর্মসূচি নিয়ে সংঘর্ষের শঙ্কায় বিএনপির নেতাকর্মীরা। তাদের আশঙ্কা, দলীয় কোন্দলের কারণে কর্মসূচির মধ্যে সংঘর্ষে জড়াতে পারে কেন্দ্রীয় দুই নেতার অনুসারীরা। তবে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে অরাজকতা করলে দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা

বরিশাল বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিএনপিতে বিরোধের নেপথ্যে কেন্দ্রীয় দুই নেতা। এদের একজন হচ্ছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব মজিবুর রহমান সারোয়ার ও অন্যজন কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস নাহার শিরিন। তারা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে স্থানীয় বিএনপিকে নিজেদের পকেটে ঢুকিয়েছেন। তাদের এই বিরোধকে কেন্দ্র স্থানীয় বিএনপিতে এখন অন্তত আরও ছয়টি উপ-গ্রুপ আছে। স্থানীয় বিএনপির এসব গ্রুপ এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।
বিশেষ করে সারোয়ার গ্রুপকে চাপে রাখতে শিরিন গ্রুপের হয়ে কাজ করছে উপ-গ্রুপগুলো। অন্যদিকে সারোয়ার গ্রুপ নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে কেন্দ্র থেকে প্রভাব খাটিয়ে আর্থিক অনিয়মের তথ্য প্রমাণসহ বরিশাল জেলা (দক্ষিণ) কমিটি ভেঙ্গে নিজেদের লোকজনদেরকে দিয়ে নতুন আহবায়ক কমিটি গঠন করেছে। এ নিয়েও এখন দুই পক্ষের মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক বিরাজ করছে। কেউ কারো মুখ পর্যন্ত দেখছেন না ।
স্থানীয় বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল মহানগর ও জেলা বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস নাহার শিরিন। অন্যদিকে মজিবুর রহমান সারোয়ার দিচ্ছেন আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্ব। তার সঙ্গে রয়েছে দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি।
বরিশাল বিএনপিতে শুধু কেন্দ্রীয় এই দুই নেতার গ্রুপই নয়, সক্রিয় আছে আরও অন্তত ছয়টি গ্রুপ। এরমধ্যে একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম-আহবায়ক মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। অন্য গ্রুপগুলোর মধ্যে একটির নেতৃত্বে আছেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবায়দুল হক চান, আরেক গ্রুপে আছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আহসান হাবিব কামাল। এই গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন জেলা দক্ষিণ বিএনপির বর্তমান আহবায়ক মুজিবুর রহমান নান্টু। অপর গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খান রাজন।
গত কয়েক বছর ধরে বরিশাল বিএনপির নেতৃত্বে থাকা দুই কেন্দ্রীয় নেতার প্রকাশ্য বিরোধের কারণে স্থানীয়ভাবে দলের কেন্দ্রের কর্মসূচি পালন হচ্ছে পৃথক পৃথক ভাবে। দুই নেতার বিরোধের মূল কারণ আধিপত্য বিস্তার। এ কারণে দুই নেতাই নিজেদের দল ভারী করতে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীর বদলে বিএনপির বিভিন্ন কমিটিতে এমন লোকজনদের স্থান করে দিয়েছেন যারা সংগঠনের ধার ধারে না। তাদের প্রত্যেককেই কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। টাকার বিনিময়ে কমিটিতে জায়গা দেওয়ার বিষয়ে এগিয়ে আছেন বিলকিস জাহান শিরিন।
বরিশাল জেলা বিএনপির অধীন গৌরনদী উপজেলা ও পৌরসভা, মুলাদী উপজেলা ও পৌরসভা এবং হিজলা উপজেলা কমিটিতে যাদেরকে নেওয়া হয়েছে তাদের প্রত্যেকেই মোটা অংকের টাকা দিয়ে কমিটিতে জায়গা করে নিয়েছেন। এর প্রতিবাদে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা গৌরনদীতে ঝাড়ু মিছিল করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মুলাদী এবং হিজলাতেও একইভাবে টাকার বিনিময়ে কমিটিতে লোকজন ঢুকানোর কারণে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে কমিটি করা নিয়ে সারোয়ার-বিলকিস দ্বন্দ্ব এতোটাই প্রকট যে, সারোয়ার তার প্রভাব কাটিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিকে দিয়ে বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নতুন কমিটি করিয়েছেন। পূর্বের কমিটি ছিল বিলকিসের অনুসারী। এতে আহবায়ক ছিলেন মুজিবুর রহমান নান্টু ও সদস্য সচিব ছিলেন আক্তার হোসেন মেবুল।
অভিযোগ ছিলো, এই কমিটি দক্ষিণ জেলা শাখার অধীন বাকেগঞ্জ উপজেলা, পৌরসভা এবং ওই উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন কমিটি গঠন করেছেন অর্থের বিনিময়ে। এতে ত্যাগী নেতাকর্মীরা স্থান পায়নি। বরং যারা টাকা দিয়েছে বা যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন তাদেরকেই কমিটিতে স্থান করে দিয়েছেন বিলকিসের অনুসারীরা।
এই অভিযোগের সূত্র ধরে সারোয়ার কেন্দ্রীয় কমিটির মাধ্যমে দক্ষিণ জেলা কমিটিটি ভেঙ্গে দিয়ে নতুন কমিটি করেন। এতে সারোয়ারের অনুসারী সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হোসেনকে আহবায়ক এবং জেলা কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম শাহীনকে সদস্য সচিব করে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। এখন বরিশাল মহানগর ও জেলা বিএনপিতে সারোয়ারের একমাত্র অনুসারী হচ্ছে দক্ষিণ জেলা কমিটি। বাকী সবগুলো কমিটিই বিলকিসের অনুসারী। অন্যদিকে বরিশাল মহানগর যুবদল ছাড়া মহানগর বিএনপি অন্য অঙ্গসংগঠনগুলো সারোয়ারের পক্ষে।
এদিকে বরিশাল সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মহানগর বিএনপির যে ১৮ জন নেতাকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করা হয়েছিল তাদের সবাইকে আবারও দলে ভিড়িয়েছেন বিলকিস নাহার শিরিন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি ব্যক্তিগত সুবিধা নিয়ে বহিষ্কৃত নেতাদের দিলে নিয়েছেন নিজের পাল্লা ভারী করতে। এ নিয়েও সারোয়ার-বিলকিস বিরোধ তুঙ্গে। সারোয়ার অনুসারীরা বলছেন, এই ১৮জনকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে বহিস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু বিলকিস তাদেরকে দলে ভিড়িয়ে শৃঙ্খলা বিরোধী কাজ করেছেন।
এদিকে সরকার বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশালে রোড মার্চ করবে বিএনপি। কিন্তু দলের ভিতরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সেই কর্মসূচি সফল করা নিয়ে শঙ্কিত মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। স্থানীয় বিএনপি কর্মী মিনার মাহমুদ বলেন, দলের নেতারা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দে লিপ্ত। তাদের পক্ষে আন্দোলন করে সরকার পতন সম্ভব না। তিনি বলেন, জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নে যেসব কমিটি গঠন করা হয়েছে সেগুলোতে টাকার বিনিময়ে বিভিন্নজনকে কমিটিতে ঢুকানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা যারা সাধারণ কর্মী, মাঠের কর্মী তাদের সমস্যা সবচেয়ে বেশি। নেতাদের বিরোধের কারণে আমাদের অবস্থা খারাপ। আরেক কর্মী লোকমান হোসেন বলেন, নেতারা যেভাবে মহানগর ও জেলা কমিটিতে বিরোধ তৈরি করে রেখেছে তাতে সরকার পতন তো দূরের কথা আন্দোলনই তো করতে পারবে না। তিনি বলেন, ত্যাগী নেতাকর্মীদের বঞ্চিত করে কোনো আন্দোলন সফল হয় না।
বিএনপির এই অভ্যন্তরীন বিরোধ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস নাহার শিরিন বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। আর বরিশাল মহানগর এবং বরিশাল উত্তর ও দক্ষিণ জেলা কমিটিসহ সকল কমিটি আমার অধীনে। এখানে কোনো বিরোধ নেই।’ অর্থের বিনিময়ে কমিটি করার কারণে দক্ষিণ জেলা কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে সারোয়ার অনুসারীদের দিয়ে কমিটি করা হয়েছে। এ বিষয়ে শিরিন বলেন, ‘এসব কে বলেছে? এগুলো সত্য নয়। কমিটি বিলুপ্ত সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে না পারায়। আর অন্য কারো লোক দিয়েও কমিটি করা হয়নি। সবাই আমার লোক। তাছাড়া ১৬ বছর ধরে দল ক্ষমতায় নাই। তাহলে টাকা পাবে কোথায়?”
এদিকে বিএনপির রোড মার্চ কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ‘বিএনপির এসব কর্মসূচি আগেও হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ভবিষ্যতেও সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা থাকবে না।’ তিনি বলেন, বিএনপি নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ সংঘাতে ব্যস্ত। তারা টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন কমিটিতে লোক ঢুকিয়ে দল ভারী করার চেষ্টা করছে। এতে কোনো লাভ নেই।’
আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের বরিশাল জেলা ও মহানগর সহ বিভিন্ন শাখা ও ইউনিটের নেতাকর্মীরা রাজপথে থাকবে। আন্দোলনের নামে বিএনপির যে কোনো সহিংসতা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিহত করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন আওয়ামী লীগের এই নেতা।

Leave A Reply

Your email address will not be published.